বন্ধনহীন জীবনে।
একজন চিরকুমারকে ঘিরে সমাজে নানা কানাঘুষা চলে। উনি কেন বিয়ে করলেন না? প্রেম-টেম ছিল নাতো? নাকি অন্য সমস্যা? উনার প্রেমিকা কি অন্যের ঘরে চলে গেছে? এইসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় চিরকুমারকে নিয়ে। তবে শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাধকদের মধ্যে চিরকুমার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। আমেরিকায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যর্থ প্রেমিকদের বেশিরভাগ থেকে যান চিরকুমার হয়ে। তারা পুরোনো প্রেমে এতটাই স্মৃতিকাতর থাকেন যে নতুন করে আর ঘরবাঁধা হয় না।
২.
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন চিরকুমার। কিন্তু তিনি কেন বিয়ে করেন নি, সে বিষয়ে কেউই তার কাছ থেকে সদুত্তর পায়নি। তাই সৈনিক জীবনে বীরত্ব দেখালেও বাস্তব জীবনে বিয়ে করে সেই শৌর্য-বীর্য তিনি দেখাতে পারেননি। প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা বিবাগীর মতো জীবন কাটিয়েছেন। অনেক সময় তিনি এ নিয়ে হাস্যরসও করতেন। ফকির আলমগীরের গানের কথা ধার করে গাইতেন, ‘আমি ঘর করলাম না রে, সংসার করলাম না রে...।’ এটা তার একটা পাগলামিও বলা যায়। এক সময় তিন বন্ধু আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদ ও আনিস সাবেত প্রতিজ্ঞা করেন, ‘সারাজীবন শিল্প-সাহিত্য দিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করব, বিয়ে করব না।’ দুই বন্ধুু ওয়াদা ভঙ্গ করলেন। কিন্তু আহমদ ছফা থেকে গেলেন অনঢ়-অটল। তিনি বিয়ে না করলেও বিচিত্র ছিল তার জীবনযাপন। পাখি পোষতেন। বিশেষ করে কাক পোষতেন। নিরলে-নিভৃতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাকের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। সাংবাদিক নির্মল সেনও ছিলেন চিরকুমার। এজন্য জীবনের শেষবেলায় নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বে খুব ভোগান্তিই পোহাতে হয়েছে তাকে।
চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান এই তালিকারই মানুষ। সারাজীবন তিনি প্রকৃতি, নিসর্গ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ছবিই এঁকেছেন। রংতুলি দিয়ে জীবন্ত করেছেন অসংখ্য বিমূর্ত নারী চরিত্রকে। কিন্তু নিজের বাস্তব জীবনের সঙ্গে জড়াননি কোনো নারীকে।
৩.
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বিখ্যাতদের মধ্যে অনেকে এখনো চিরকুমার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম আজাদ, বিখ্যাত টাটা কোম্পানির মালিক রতন টাটা, চিত্রনায়ক সালমান খান। সালমান খান যদিও ঘোষণা দিয়েছেন আজীবন চিরকুমার থাকবেন, কিন্তু নায়ক বলে কথা! যেকোনো মুহূর্তে সেই ওয়াদা ভেঙেও যেতে পারে।
এতদিন নরেন্দ্র মোদি বলে আসছিলেন যে, তিনি চিরকুমার। কিন্তু এবারে নির্বাচনী হলফনামায় সত্যটাকে প্রকাশ করতেই হলো। অনেক আগেই যে তিনি বিয়ের কাজটা সেরেছেন সেটা জানতে পারল গোটা ভারতবাসী।
আমাদের দেশে বিয়ে না করে জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বিপত্তিতে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া। বিয়ে না করায় কাছের কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই এখন তার সঙ্গে। তাই রাজধানীর মহাখালীর বিশাল আলিশান বাসায় এখন নিঃসঙ্গ ও বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন এই শিক্ষাবিদ। যেকোনো সময় দখলও হয়ে যেতে পারে তার বাড়িটি।
৪.
একসময় বামপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে বিয়ে না করার প্রবণতা বেশি দেখা যেত। এদের অনেকে মনে করতেন, বিয়ের কারণে সমাজ-বিপ্লবের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তবে এখনো বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের অধিকাংশ নেতা চিরকুমার। দল থেকে কোনো বাধা না থাকলেও এ দলের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ ক’জন নেতা অবিবাহিত রয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান এখনো চিরকুমার।
৫.
আজাচৌ নামে পরিচিত চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী ছিলেন চিরকুমার। তবে মৃত্যুর আগে তিনি এ নিয়ে ভীষণ আফসোস করেছিলেন বলে তার বন্ধুদের কাছে শোনা যায়। তিনি বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘সংসার যাপনের অভিজ্ঞতা অর্জন না করাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যর্থতা।’ আবার এমনো অনেকে আছেন যারা বিয়ে না করাকে পুরুষত্বের অহম মনে করে থাকেন।
তবে শেষ বয়সে চিরকুমার থাকার ভোগান্তি লক্ষ করা যায়। বয়স যত বাড়ে, ধীরে ধীরে কমতে থাকে আড্ডার সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব। আত্মীয়-স্বজনও ব্যস্ত থাকেন যে যার মতো সংসার জীবন নিয়ে, তখন একজন চিরকুমারকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো ছাড়া আর দ্বিতীয় কিছু করার উপায় থাকে না।
৬.
বিয়েকে অনেকে অভিহিত করেন দিল্লিকা লাড্ডু হিসেবে। খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও পস্তাতে হয়। তাই কেউ কেউ বলেন, পস্তাতেই যদি হয় তাহলে খেয়েই পস্তানো ভালো। আমাদের এই সময়ের চিরকুমার গীতি কবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী অবশ্য এই যুক্তির ঘোর বিরোধী। আড্ডায়-অনুষ্ঠানে তাকে যতই খোঁচানো হোক না কেন তিনি কখনোই তার বিয়ে না করার রহস্যের জাল উন্মুক্ত করেন না।
সে যাই হোক, প্রশান্তিই বড় কথা। কেউ বিয়ে না করে যদি সুখে থাকেন তাহলে কারোর ক্ষতি হওয়ার কারণ নেই। আমাদের শুধু শুভকামনা, ভালো থাকুক চিরকুমাররা।
Comments
Post a Comment